রাঙামাটি ভ্রমন




নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা।  পাহাড় নদী ও লেকবেষ্টিত একটি বৈচিত্র্যময় জনপদ যেখানে চাকমা,মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, বোম, খুমি, খেয়াং, লুসাই, রাখাইন সর্বোপরি বাঙালি সহ 14 টি জনগোষ্ঠীর বসবাস।  এখানে কিছু অসমীয়া ও গুর্খা সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে। ভৌগলিক বৈচিত্র সৌন্দর্য এবং বিভিন্ন ধর্ম বর্ণ ভাষা-সংস্কৃতির সম্মেলন যোগ করেছে এক ভিন্নমাত্রা। 

 শুভলং, রাঙামাটি

 শুভলং ঝর্ণাটি বেশ আকর্ষণীয়। এখানে স্নান করলে মন ভরে যাবে আনন্দে। কাপ্তাই লেকের কোলে বিশাল উঁচু পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরনার জল এসে পড়ে নিচে।  যদিও এসময়ে ঝর্ণার জলে কিছুটা ঘাটতি দেখা যায়। ইচ্ছে হলে বোট থামিয়ে ঝর্ণার জলে শরীরটা ভিজিয়ে নিতে পারেন। শুভলং যাওয়ার পথে আরও দু-একটি ছোট ছোট ঝর্ণার দেখা মিলবে।  সেগুলো দেখে নিতে পারেন। 
কিভাবে যাবেনঃ রাঙ্গামাটি শহর থেকে ইঞ্জিন বোটে যেতে সময় লাগে প্রায় দুই ঘণ্টা। রিজার্ভ বাজার, তবলছড়ি বাজারে  এবং পর্যটন কমপ্লেক্স থেকে ইঞ্জিন বোট ভাড়া পাওয়া যায়। যাওয়া-আসার ভাড়া সাতশো থেকে পনেরশো টাকা। যেতে পারবেন ১০ থেকে ২০জন। সম্প্রতি চালু হয়েছে এই পথে আধুনিক জলযান কেয়ারী কর্ণফুলী।  এছাড়া রিজার্ভ বাজার থেকে সকাল থেকে দুপুরের পর পর্যন্ত লোকাল লঞ্চ ছাড়ে। বিভিন্ন গন্তব্যে সকালে উঠলে ফিরতি পথেও পেয়ে যাবেন কোন লঞ্চ। ঘুরে আসতে পারেন সেসব কোন লঞ্চে। শুভলং যত না সুন্দর তার চেয়ে আরো সুন্দর এর যাওয়ার পথটি। দুপাশে উচু পাহাড় তার মাঝে থেকে নিরবে বয়ে চলা কাপ্তাই লেক। শুভলং ঝর্ণা থেকে শুভলং বাজারে যাওয়ার পথে আছে আরো ঝর্ণা। আছে  পাহাড়ে সবুজের মাখামাখি। দিগন্তবিস্তৃত আকাশের কেন্দ্র জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য কিংবা জলে ডুবে থাকা মরা মাছের ডালে মাছরাঙার আর গঙ্গা ফড়িং এর ওড়াউড়ি। শীতের সেই জলের স্বচ্ছ জল নেই, তবে বাদলের ঘোলাটে জলেও পাহাড়ের ছায়া পড়ে। সে জলের উপর দিয়ে রাঙামাটির পর্যটন ঘাট বা বাজার ঘাট থেকে ইঞ্জিন বোটে করে দ্বীপ রেস্তোরাঁ পেদা টিং টিং শুভলং ঝর্ণা টু শুভলং বাজার ট্রিপটা তাই রাঙ্গামাটির এক অন্যরকম এক ভালো লাগা ভ্রমণ। একদিনের জন্য এক চমৎকার ভ্রমণ প্যাকেজ। 

 পর্যটন মোটেল ও ঝুলন্ত সেতু

 রাঙামাটি শহরের শেষ প্রান্তে কর্ণফুলী হ্রদের  কোল ঘেঁষে ১৯৮৬ সালে গড়ে উঠেছে 'পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্স'। এখানে রয়েছে মনোরম 'পর্যটন মোটেল'। পর্যটন  মডেল এলাকা 'ডিয়ার পার্ক' নামেই সমধিক পরিচিত। মোটেল এলাকা থেকে দৃশ্যমান বিস্তীর্ণ জলরাশি আর দূরে নীল উঁচু-নিচু পাহাড়ের সারি এখানে তৈরি করেছে এক নৈসর্গিক আবহ। এখানেই রয়েছে ৩৩৫ ফুট দীর্ঘ মনোহরা ঝুলন্ত  সেতু- যা এই এলাকার গুরুত্ব ও আকর্ষণ বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। এই সেতু ইতোমধ্যে 'সিম্বল অব রাঙামাটি' হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এছাড়া অডিটোরিয়াম, পিকনিক স্পট, স্পিড বোর্ড ও দেশীয় নৌ-যান।
  যাতায়াতঃ  রাঙামাটি শহরের তবলছড়ি হয়ে সড়কপথের সরাসরি পর্যটন কমপ্লেক্সে যাওয়া যায়। এখানে গাড়ী পার্কিং এর সুব্যবস্থা রয়েছে। যারা সার্ভিস বাসে করে আসবেন তাদের অটোরিক্সা রিজার্ভ করে যেতে হবে। দূরালাপনিঃ ০৩৫১-৬২১২৬, ৬১০৪৬

 ডিসি বাংলো জাদুঘর, রাঙামাটি

 প্রাকৃতিক অনাবিল সৌন্দর্যের আঁধারে নির্মিত রাঙামাটির ডিসি বাংলো জাদুঘর। এখানে পার্বত্য অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাসের বহু স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষিত আজকে রাঙামাটির নানিয়ারচরে বুড়িঘাটের এর বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফের স্মৃতিসৌধের ছবি ও জেলা প্রশাসক এলএইচ নিবলেটের স্মৃতিস্তম্ভটি সংস্কৃতির নিদর্শন গুলোর স্থান পেয়েছে ডিসি বাংলো জাদুঘরে। পাহাড়ের বুকে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা অজানা সব ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে 2012 সালের 26 শে মার্চ তৎকালীন জেলা প্রশাসক সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এই জাদুঘর নির্মাণ করেন। রাঙামাটি শহরের পূর্ব প্রান্তে বাংলোটির অবস্থান।  শুধু সংযোগ সড়ক ছাড়া বাংলোর সব দিকে ঘিরে রয়েছে কাপ্তাই হৃদয়ের স্বচ্ছ জলরাশি। ১৮৬৮ সালে রাঙামাটি জেলার সদর স্থানের উপর নির্মিত হয় এ বাংলো এবং কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের পর ১৯৬২ সালে রাঙ্গামাটি শহর হ্রদের পানিতে তলিয়ে গেলেও পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থানের কারণে এ বাংলো টিকে আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে ডিসি বাংলো জাদুঘর।

 রাঙ্গামাটিতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী চাকমা,মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, বোম, খুমি, খেয়াং, চাক, পাংখোয়া, লুসাই, অসমীয়া, সাঁওতাল, রাখাইন সর্বোপরি বাঙালিসহ ১৪টি সম্প্রদায়ের বসবাস। ভৌগলিক বৈচিত্র সৌন্দর্য এবং বিভিন্ন ধর্ম বর্ণ ভাষা-সংস্কৃতির সম্মেলন যোগ করেছে এক ভিন্নমাত্রা।  রাঙামাটির ধ্বংসাবশেষের পাথর, ১৮৬৬ সালের প্রথম টাইপরাইটার, গান্টার চেইন, রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের প্রাচীন ঐতিহ্য টেবিল-চেয়ার, পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সৃষ্টির সময় থেকে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ছোট আলমারি, ১৯৫৩ সাল থেকে সংরক্ষিত ক্যালেন্ডার, বর্ষপঞ্জি, রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের বিংশ শতাব্দীর প্রাচীন ঘড়ি, সাইটভ্যান, টেবিল সহ নানা দুর্লভ স্মৃতিচিন্হ সংরক্ষণ করা হয়েছে।

 কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র

 বিদ্যুৎ ছাড়া একটি দিনও এখনকার নগরবাসী কল্পনা করতে পারে না। তাই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মানুষের নানাবিধ চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মানুষের এই  চেষ্টার একটি ফসল হলো পানি থেকে বিদ্যুৎ তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার। বিদ্যুৎ তৈরির অন্যান্য পদ্ধতির চেয়ে পানি থেকে বিদ্যুৎ তৈরি অনেক সাশ্রয়ী। বাংলাদেশেও পানি থেকে বিদ্যুৎ তৈরির জন্য একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলায় কর্ণফুলী নদীর উপর বাঁধ দিয়ে এই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়। ১৯৬২এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু হয়। এই প্রকল্পটি তৈরীর জন্য সেখানে বিশাল জলাশয় সৃষ্টি হয়েছে। সেটি 'কাপ্তাই লেক' নামে পরিচিত। পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ১৬টি কপাট যুক্ত করা হয়েছে। এগুলো দিয়ে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি প্রবাহ নিশ্চিত করা হয়। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে অল্প খরচে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ফলে যে জলাধার সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে প্রতিবছর প্রায় ৭০০টন মাছ চাষ হয়। অবশ্য এই জলাধারের কারণে বহু মানুষকে সেসময় গৃহহীন হতে হয়। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আমাদের জাতীয় জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। 


 কর্ণফুলী হ্রদ

১৯৬০  খ্রিস্টাব্দে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে কর্ণফুলি হ্রদের সৃষ্টি হয়। কৃত্রিম এই হ্রদের আয়তন ২৯২ বর্গমাইলে। এই হ্রদের সাথে কর্ণফুলী, কাচালং আর মাইনী নদীর রয়েছে নিবিড় সংযোগ। কাচালং নদীর উজানে লংগদুর মাইনীমুখী এসে হ্রদের বিস্তার দেখে যুগপৎ বিস্মিত হতে হয়।

 এখানে লেকের বিস্তীর্ণ জলরাশি নির্দ্বিধায় আকাশের সাথে মিশে গেছে। রাঙ্গামাটি শহরে এলেই চোখে পড়ে লেক-পাহাড়ের অকৃত্রিম সহবস্থান। যা দেশের আর কোথাও দেখা মেলে না। এই লেকের স্বচ্ছ জলরাশি আর সবুজ পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য পর্যটকদের কাছে টানে  আর লেকে নৌ-ভ্রমণের কারো মন প্রাণ জুড়িয়ে দেয় প্রকৃতির আপন মহিমায়।

 যাতায়তঃ নৌ-ভ্রমণের জন্য রিজার্ভ বাজার, তবলছড়ি ও পর্যটন ঘাটে ভাড়ার স্পিডবোট ও নৌযান পাওয়া যায়। যার ভাড়ার পরিমাণ ঘণ্টাপ্রতি স্পিড বোর্ড ঘন্টায় ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা এবং দেশীয় নৌযান ৪০০ থেকে ৮০০ টাকা।

 রাঙামাটির টিপস-

১.  যদি শরৎকালের যান তাহলে এই বৃষ্টি এই রোদ। সঙ্গে ছাতা রাখুন। আবার রোদের জন্য সানস্ক্রিন লোশন,রোদচশমা সঙ্গে নিতে পারেন।

২. ঝরনায় ভেজাল ইচ্ছা থাকলে নিয়ে যান একাধিক কাপড়। নাহলে ভেজা কাপড়ে থাকতে হবে ঘন্টার পর ঘন্টা।

৩.  সঙ্গে অবশ্যই খাবার পানি নিয়ে যাবেন।

৪.  বৃষ্টি হলে পাহাড়ে না ওটাই ভালো পিছলে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

৫. পাহাড়ে উঠলেও বেশি ভেতরে যাবেন না পাহাড়ি ও সেনাবাহিনীর মধ্যে এখনো কোথাও কোথাও অস্থিরতা চলে।

No comments:

Post a Comment

@templatesyard